রাবেয়া রব্বানী অনূদিত
১
চাইনিজ গর্ডনের ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেছে।
ঠক ঠক শব্দটা সে আবার শুনতে পেল, এবার বিড়ালটাও যে শুনতে পেয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিড়ালটার নাম ডক্টর হেনরি মেৎসগার। ডক্টর হেনরি মেৎসগার কিছুক্ষণ চাইনিজ গর্ডনের কম্বলের উপর নরম পাউরুটির টুকরোর মতো পড়ে থেকে কান দুটো সোজা একজোড়া চামচের মতো করে শব্দটা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছে তারপর উঠে বসে তার থাবায় জিভ ছুঁইয়ে নিশ্চল হয়ে গেছে। হয়ত শব্দের এমন একটি তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হেনরি মেৎসগার শুনতে পেয়েছে যা চাইনিজ গর্ডন শুনতে পায়নি।
চাইনিজ গর্ডন ফিসফিস করে বলল, “কিসের শব্দ রে? কেউ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে চাইছে। তাই না?”
ডক্টর হেনরি মেৎসগার এবার শব্দটা থেকে মনোযোগ সরিয়ে চাইনিজ গর্ডনের বুকের উপর দিয়ে হেঁটে, কপালে পা রেখে অতিরিক্ত বালিশটার দিকে সরে গেল। শব্দটা মানুষের তৈরি বুঝতে পেরে যেন তার আগ্রহে ভাটা পড়েছে।
ধুর, সিঁধ কাটা চোর! ভাবল চাইনিজ গর্ডন। সে বিছানা থেকে নেমে নিঃশব্দে দরজার পাশে এসে কান পাতলো। নিচতলার গ্যারেজের দরজার হাতল ঘোরানোর ক্ষীণ একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে অন্ধকারে চোখ বড় বড় করে যথাসম্ভব দেখার চেষ্টা করল কিন্তু দোকানের মেশিনগুলোর আবছা অবকাঠামো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। গ্যারেজের দরজা আর একটু খুলতেই এক মুহূর্তের জন্য একটি মানুষের পরিছায়া দেখা গেল। লোকটা ভেতরে ঢুকল, তারপর আরও একজন ঢুকল আর তারপর আরও একজন।
চাইনিজ গর্ডন উপর তলা থেকে নিচু হয়ে চুপচাপ দেখতে লাগল। তিনজন লোক একসাথে ঢুকেছে, তার উপর বন্ধুকটা নিচতলায় পেছনের কামড়ার যন্ত্রপাতির ড্রয়ারে তালা দিয়ে রাখা আছে। এর চেয়ে আর খারাপ আর কিছু হতে পারে না কেননা লোকগুলো আরও কিছুটা সময় পেলে হয়ত বন্ধুকটা খুঁজে পাবে।
কিছু না দেখা গেলেও চাইনিজ গর্ডন আন্দাজ করতে পারল লোকগুলো সবে মাত্র গ্যারেজের দরজার কাছে এসেছে। খুব সম্ভবত তারা দোকানে চলাফেরার আগে অন্ধকারের সাথে নিজেদের চোখকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। চাইনিজ গর্ডন মনে মনে ভাবল, কি একটা ফালতু পরিস্থিতি! এরা হয়ত কেবল কমবয়সী ছেলেপেলে বা মাতাল বা নেশাখোর, কিছু দামি মেশিন ও যন্ত্রপাতি হাতিয়ে নিতে এসেছে কিন্তু কম বয়সী হোক আর বেশি বয়সী, মাতাল হোক বা ডাকাত, এর মানে তো এই না যে বাতি জ্বালালে কিংবা চিৎকার চেঁচামেচি করলে এরা আমাকে খুন করবে না।
সে হঠাৎ খেয়াল করল ডক্টর হেনরি মেৎসগার তার পিছনে মুখ ঘষছে আর গড়গড় করছে। হেনরি মেৎসগার গড়গড় করা থামিয়ে নিশ্চল হয়ে নিচের দিকে তাকাতেই চাইনিজ গর্ডন নিশ্চিত হল নিচে একজন লোক নড়াচড়া শুরু করেছে। সে বেড়ালটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, স্থির অপলক চোখদুটো অন্ধকারের দিকে স্থির হয়ে আছে। একটু পর হেনরি মেৎসগার গুড়ি মেরে শুয়ে সিঁড়ির প্রান্ত থেকে নিচের দিকে উকি দিলো, তার কান-দুটো পিছনের দিকে থাকায় হয়ত নিচ থেকে তার মাথার কোন পরিছায়া দেখা যায় নি। কেউ একজন এখন অবশ্যই তাদের একেবারে বরাবর নিচতলায় দাঁড়িয়ে আছে, হয়ত সে পেগ-বোর্ডে ঝুলানো পাওয়ার টুলগুলো দেখতে উপরে তাকিয়েছে, ভাবল চাইনিজ গর্ডন।
সে কেবল কান পেতে থেকেই লোকটার অবয়ব অনুভব করতে পারল। বেঞ্চের উপর হেলান দিয়ে লোকটা হয়ত যন্ত্রগুলোর দাম, ওজন এবং ভার সম্পর্কে ধারণা নিতে চাইছে । হ্যাঁ এখন নিশ্চয়ই সে ইলেকট্রিক ড্রিলের যন্ত্রটার কাছে পৌঁছেছে। চাইনিজ গর্ডন এবার যা করার সিদ্ধান্ত নিলো তা ভেবেই একটা অপরাধ বোধ তার বুকের ভেতর টনটন করে উঠল। সে জানে কাজটা করা ঠিক হবে না এবং হতে পারে এতে আরও ঝামেলা বাড়বে কিংবা ব্যাপারটা এমন কোনো দিকে গড়াবে যা এখন সে কল্পনাও করতে পারছে না কিন্তু আর অন্য কোন পথও তো খোলা নেই তার।
প্রথমে সে খুব শান্তভাবে ডক্টর হেনরি মেৎসগারের ঘন, নরম পশমে হাত বুলালো তারপর কোন কিছু জানান না দিয়েই বিড়ালটাকে উপরের দিকে তুলে নিচতলায় ফেলে দিল। নিচতলায় পড়ে যেতেই ডক্টর হেনরি মেতজগার ভয়, বিস্ময় এবং রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে তীক্ষ্ণ স্বরে গর্জন করে উঠল।
চাইনিজ গর্ডন তাৎক্ষণিক ভাবেই নিশ্চিত হলো শূন্যে বেড়ালটির পতনের সম্ভাব্য পথ সে ঠিকঠাক অনুমান করতে পেরেছে। মাত্র পাছ ছ ফিট নিচে পড়তেই হেনরি মেৎসগারের গর্জনের স্বর বদলে গেছে এবং তার সাথে যোগ হয়েছে মানুষের আর্তনাদ। নিশ্চয়ই বিড়ালটি একজন মানুষের মাথার উপর পড়েছে এবং পায়ের পাতা দিয়ে ভারসাম্য রাখতে লোকটার শরীরে ভয়াবহভাবে আঁচড় কেটে দিয়েছে কারণ লোকটার চিৎকারে কেবল ভয় না শারীরিক কষ্টও বোঝা গেছে।
এখন আরোও শব্দ ভেসে আসছে। লোকটার কোঁকানি এবং আর্ত চিৎকারের সাথে বাকি দুজন লোকও চিৎকারও করছে, “কি এটা?”
“কি এটা? কি?” আরও একজন চেঁচিয়ে উঠল, তারপর ফুটপাতে নিরুদ্ধ করে রাখার পরও অল্প অল্প দোল খাওয়া লেদ মেশিনটার দিকে দৌড়ে গেল। সেখানে গিয়ে লোকটা হয়ত কোনোভাবে ব্যথা পেল কেননা তারপরই লোকটার ঊর্ধ্বশ্বাস আর অসংলগ্ন বিলাপ ভেসে এলো।
“চুপ কর! চুপ করে থাক হারামজাদা,” হঠাৎ কেউ একজন এভাবে চেঁচিয়ে উঠল যেন আহত লোকটাকে চুপ করাতে না পারলে সে নিজেই গুলি করে মারবে।
উপরতলায় চাইনিজ গর্ডন এখন তার পেটের উপর সমান হয়ে শুয়ে শুনতে পেল, নিচতলায় একজন লোক বলছে, আমাদের যেভাবেই হোক এখান থেকে বেরুতে হবে।
নেতা গোছের কণ্ঠে একজন বলছে, “হলোটা কি? একটা বাচ্চার মতো কিছু মনে হলো না?”
অন্যজন বলছে, “ঈশ্বর! আমার রক্তপাত হচ্ছে।”
চাইনিজ গর্ডন তাদের এগিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেয়ে সিঁড়ির প্রান্ত থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, আংশিক খোলা গ্যারেজের দরজা দিয়ে লোকগুলো একে একে পালিয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পর শোনা গেল সজোরে গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে ইঞ্জিন চালু হওয়ার শব্দ।
২
লসএঞ্জেলস বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরের ফুটপাতটা কোলাহল মুখর ও বিশৃঙ্খল। মানুষের হেঁটে চলার কোন নির্দিষ্ট ঢং নেই, মাঝে মাঝে দু-তিন জন পাশাপাশি হাঁটে। থেমে থেমে লোকজনকে যেতে দিতে হচ্ছে ব্যাপারটা নক্স মরিসনের একদমই ভালো লাগছে না। তার সাথে বিপদজনক আরও একটি উপাদান হিসাবে যোগ হয়েছে, বাই-সাইকেল। যেগুলো যেকোনো সময় যেকোনো দিক থেকে ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে থাকা মানুষকে আহত করতে পারে আর তাও এমন গতিতে চলছে সাইকেলগুলো যে চাইলেই একটা দূরত্ব রাখা বা হুট-হাট থামানোর কৌশল ব্যবহার করতে পারবে না চালক। জন নক্স মরিসন যখনি কোন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর পরিদর্শনে যান এই ঝামেলা এড়িয়ে যেতে পারেন। অন্য সব ক্ষেত্রে কেউ না কেউ তাকে এয়ারপোর্ট থেকে তুলে একেবারে সঠিক দালানের কাছে এনে পৌঁছে দেয় কিন্তু লস এঞ্জেলসের ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। এখানে তাকে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্পাসের ভিন্ন ভিন্ন মানুষজনের সাথে দেখা করতে হয়। আসলে ওয়াশিংটনে বসে বসে পশ্চিমে আসার ঝামেলার কথা মনেই থাকে না। আশি মাইল লম্বা এবং আশি মাইল চওড়া একটি শহরকে এক বাক্যে কল্পনা করা এত সহজ না।
ইউএলএ-তে তিনি অন্তত এটা বুঝতে পারেন যে তিনি কোথায় যাচ্ছেন। দুপুরের খাবারের সময় না হলে হাতের কাছের একটা রোমান যুগীয় দালানের সামনে একটি ডোনাট খেতে থামতে পারেন। তবে তার ধারণা এখানকার বেশির ভাগ যুবক-যুবতীদের চেয়ে এলাকাটা তিনি ভালো চেনেন। কারণ এরা যখন বাচ্চা প্রায় তখন থেকেই তিনি এখানে আসেন।
পাশ দিয়ে যাওয়ার করার সময় দুশ্চিন্তা নিয়ে তার চোখের দিকে তাকালো এক তরুণী। তাকে কেমন দেখায় তার একটা বিশেষ উদাহরণ ব্যাপারটা। যখন অন্তর্মুখী এবং আত্মবিশ্বাসহীন কম বয়সী ছেলেপেলে একজন ধুসর চুলের ধুসর কোট পড়া লোকের উপর দৃষ্টি ফেলে তখন বুঝতে হবে ভিড়ের মধ্যে তার অবয়ব কিছুটা নজর কাড়ে। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো তার বয়স কি মেয়েটার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মেয়েটা হয়ত ভেবেছে সে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন বা ভাইস প্রেসিডেন্ট জাতীয় কিছু। তার মতো এমন একজন ধুসর চুলের মানুষের এখানে থাকার মানে হলো তিনি অনেক আগেই এখানকার মিডটার্ম পরীক্ষায় পাস করে গেছেন, সকল বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন। ব্যাপারটা হয়ত মেয়েটার কাছে চমৎকার লেগেছে।
রাস্তার মোড় ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চওড়া রাজপথে পা বাড়াতেই ব্যাপারটা ভেবে জন নক্স মরিসন নিজে নিজেই বেশ মজা পেলেন। মেয়েটা হয়ত ধাঁধায় পড়ে যাবে বা হতাশ হবে যখন সে জানতে পারবে তিনি আসলে কে। কিন্তু আসলে যে-কোনো ডিন বা ভাইস-প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তিনি। যদি এই তরুণী মেয়েটি ফিজিক্স, ক্যামেস্ট্রি বা বায়োলজির কোন কোর্স নেয় তবে সে যে যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করে তা এখানে এসেছে কারণ তিনি তার নির্দেশ দিয়েছেন। সে যদি সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করে থাকে তবে তা সম্ভব হয়েছে কারণ তিনি ১৯৬৮ সালে এই বিশ্ব-বিদ্যালয়কে তার অনুমোদন দিয়েছেন। তার অবদানের তালিকাটা এত লম্বা আর তার সাথে এত সংশ্লিষ্ট বিষয় আছে যে এই মুহূর্তে তা নিয়ে ভাবতে জন নক্স মরিসনের ভালো লাগছে না, তার এই সব কাজের ফসল হয়ত এই শতক না গেলে স্পষ্ট হবে না।
তিনি যখন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তখন সেখানে ইতিহাসের সবচেয়ে জোরালো ,অন্যতম উপাদান নিশ্চিত করতেই যান। জন নক্স মরিসন ছিলেন দা ফেডারেল গভারমেন্টস ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চারজন মহান সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসারের একজন, এরপর তিনি হয়ে ওঠেন এজেন্সির সবচেয়ে ক্ষমতাবান এবং অর্থবান যারা সরকারি অনুদানের বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটিয়ে থাকেন। যখন তিনি কোন প্রফেসর, ডিন বা ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেন তখন যে তাদের পদমর্যাদা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সব মুছে যায় এই এবং তারা একটি সাধারণ নিরর্থক সামাজিক চরিত্রে পরিণত হয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। জন নক্স মরিসন তার অর্থের ক্ষমতা দিয়ে কথা বলেন।
++++
মরিসন সামাজিক বিজ্ঞান ভবনে পৌঁছে তৃতীয় তলা পর্যন্ত লিফটে উঠে সোজা ইয়ান দনাহিউর অফিসে গেলেন। দরজায় কেবল লেখা “৩০০-৩০৭ প্রফেশন দনাহিউ”। ভেতরে একটি অভ্যর্থনা কক্ষ এবং তারপর একটি হলওয়ের পর ছোট কিছু কক্ষ। মরিসন একটি কামড়া অতিক্রম করলেন যেখানে একটি দাড়িওয়ালা যুবক কম্পিউটারের ডিসপ্লে পর্দায় রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছে এবং আর একটি কক্ষে দুটো মেয়ে বসে কফি পান করছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে মেশিন দিয়ে যাচাই করা উত্তর পত্রের ফর্দ বানাচ্ছে।
হলের শেষে তার ব্যক্তিগত কামড়ায় দনাহিউ মরিসনের জন্য অপেক্ষা করছিল। মরিসন ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করেই দনাহিউর গোলগাল ভাঁজহীন মুখে একটা কাষ্ঠহাসি খেলে গেল। সে বলল, তোমাকে দেখে ভালো লাগল, জন। কেমন আছ?
দারুণ। একেবারে বেশ ভালো আছি,উত্তর দিলেন মরিসন।
দেখা হলেই দনাহিউর আচরণ সবসময় মরিসনকে ধাঁধায় ফেলে দেয়। তার কাছে মনে হয় কোন না কোন ভাবে তিনি দনাহিউর বন্ধুই। তার সাথে যখন মরিসনের প্রথম পরিচয় তখন দনাহিউ তার নিয়োগের পঞ্চম বছরে সহকারী প্রভাষকের পদে আসীন। তখন তার কাজে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অবদান প্রকাশ পায়নি বা তার বিগত দুই বছরের ক্ষমতা বিবেচনা করে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারার সম্ভাবনাও তার মধ্যে দেখা যায় নি। সেসময় ইয়ান দনাহিউর অফিস একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ছোট কামড়ায় ছিল যেখানে তাকে আর একজন হিংস্র ও গায়ে পড়া সহকর্মীর সাথে কামরাটা ভাগ করে নিতে হত। তার এলোমেলো কাপড় আর টুথব্রাশ দেখলে বোঝা যেত সে মেয়েদের সাথে রাত কাটাত। সেটা নিশ্চয়ই তার জন্য একটি বাজে সময় ছিল। নিজের জন্য সে কেবল একটি কাজই করছিল আর তা হলো সোসিওম্যাট্রি নামক একটি অখ্যাত কেতাবি পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করা যা সে জাতীয় গভেষণা পরিষদে অনুদান পেয়েছিল। জার্নালটি পড়েছে এমন ২০ থেকে ৩০ জন সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক মধ্যে কারোই নজর কাড়েনি। কিন্তু মরিসনের অফিসে সেটা আলোড়ন তোলার যথেষ্ট কারণ ছিল। এমনকি শিরোনামটা মরিসনের এখনো মনে আছে – ১৯৪৬ সালের জালিসো দুর্ভিক্ষ : একটি রাশিকরণ।
প্রবন্ধের বেশির ভাগ অংশই মরিসন এবং মরিসনের সহকর্মীদের মুগ্ধ করেনি। সেটা ছিল কেবল জনসংখ্যা পরিসংখ্যানের একটি ব্যাখ্যা। মরিসন তখন আগ্রহী হয়েছিলেন একটা জিনিস দেখে আর তা হলো, একটি অদ্ভুত সংস্কৃতি সম্পর্কে এমন স্বতন্ত্র অবাস্তব ধারণা নির্ণয় করা সম্ভব এবং তার মান সংখ্যায় হিসাব করে দেখাও সম্ভব যে কেন লোকজন তখন এমন অযৌক্তিক আচরণ করেছিল। তখনকার সময়ে ফসলের মাঠের একটি উদাহরণযোগ্য সমস্যা ছিল জালিসো সমস্যা। ১৯৪৬ সালের গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি যখন শস্যগুলো ফসলের মাঠে ভালোভাবেই বেড়ে উঠেছিল, আবহাওয়াও যখন বেশ ভালো ছিল এবং কোন সমস্যাই তেমন ভাবে দৃষ্টিগোচর হয় নি তখন একটি গুজব রটে গিয়েছিল যে জালিসোতে একটি দুর্ভিক্ষের আক্রমণ হয়েছে। যার কারণে বিশ হাজার সাধারণ চাষি তাদের খামার ছেড়ে, এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই এতগুলো কৃষক কাজ বন্ধ করে পালিয়ে যাওয়ার ফলে তেমন শস্য উৎপাদিত হয় নি। হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে থেকেছে এবং দুর্ভিক্ষের গুজব সত্যি হয়ে উঠেছে।
ইয়ান দনাহিউ,একজন অপরিচিত, সম্ভাবনাহীন, সহকারী অধ্যাপক হওয়া সত্ত্বেও এমন একটা ধারণায় কাজটা করেছে ব্যাপারটা মরিসনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। যদি অতীতের কোন একটি সাংস্কৃতিক ভীতির উপর এভাবে মান আরোপ করা সম্ভব তাহলে এভাবে বর্তমানেও মান আরোপ করা যাবে। যদি দনাহিউ অতীত আচার আচরণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে পারে তাহলে তার সূত্র দিয়ে সে ভবিষ্যতের ব্যাখ্যাও দিতে পারবে। মরিসন বুঝতে পেরেছিল এভাবে যদি কোন কিছুর মান অনুমান করা সম্ভব নাও হয় তবে যদি পরিমাণটা জানা যায় তবে তার মানও ব্যবস্থাপত্র করে নেওয়া যাবে। মরিসন তখন এও বুঝেছিলেন কিছু মানুষ দনাহিউয়ের এই গবেষণা সংক্রান্ত কাজে বেশ আগ্রহ দেখাবে।
সেই থেকে দনাহিউর যাত্রা শুরু। সফলতার ধারাবাহিকতা এরপর থেকে প্রায় বিশ বছর ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে। পুরো সমাজবিদ্যা বিভাগের মধ্যে ইয়ান দনাহিউয়ের সমাজ বিজ্ঞান দালানে অবস্থিত অফিস কার্যালয়টি সবচেয়ে সুন্দর এবং বিলাসবহুল।
মরিসন এখন যে চেয়ারটায় বসে আছেন সেখান থেকে ক্যাম্পাসের বাইরের দিক দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন ধুসর একটা শহরে গাছ ও বাগানের একটি ছোট পার্ক হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করেছে।
মরিসন বললেন,এটা ইতিমধ্যে নভেম্বর মাস ইয়ান। ওয়াশিংটনে দেখেই বুঝা যায় এটা নভেম্বর মাস কিন্তু এখানে যখনি আসি মনে হয় আগস্ট মাস চলছে।
দনাহিউ বলল, আমি জানি। ডিসেম্বরের শুরুতে আমি চুড়ান্ত প্রতিবেদন হাতে পাব। আমি কথা দিচ্ছি সব ঠিকঠাক থাকলে অন্তত এটা তোমার টেবিলে থ্যাংকস গিভিংয়ের আগেই থাকবে।
মরিসন বললেন, না আমি রিপোর্টের জন্য আসি নি। আমি ইউ এস সির একজনের সাথে কথা বলতে এসেছি। ভাবলাম তোমাকেও দেখে যাই এবং এবারের কাজটা আমাকে আরও কিছু জায়গা পরিদর্শন করার সুযোগ দিয়েছে।
দনাহিউ মাথা নাড়ল। কয়েকদিন আগে সে পত্রিকায় পড়েছে সরকারি আমলাদের ভ্রমণ খরচ সম্পর্কে একটি কংগ্রেশনাল কমিটি খোঁজ খবর নিচ্ছে। মরিসনের মতো একজন ব্যক্তির ভ্রমণ নিয়েও যথা সম্ভব ব্যবসায়িক স্বার্থ বিবেচনা করার কথা।
মরিসন বললেন, সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, লাতিন আমেরিকার জন্য বরাদ্দকৃত অনুদান জানুয়ারি মাসে ফুরিয়ে যাবে। আমি জানিনা এরপর তোমার মাথায় কি পরিকল্পনা আছে।
দনাহিউ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমার পরিকল্পনা যথারীতি তাই যা আমি একটু আগে বললাম। চূড়ান্ত প্রতিবেদন এক মাস আগেই যাবে এবং একটি পুনঃনবায়নের আবেদন নিয়ে। এই মুহূর্তে আমরা উৎপাদনের বেশ অগ্রগতির মধ্যে আছি। আমার মনে হয় না কাগজ পত্রগুলো দেখলে তোমার মনে সন্দেহ অবশিষ্ট থাকবে।
আমি জানি তুমি ঠিক বলছ ইয়ান কিন্ত আমার মনে হচ্ছে না তুমি বুঝতে পারছ আমি কি বলছি। আমি তোমার অনুদানের কথা বলছি না যা জানুয়ারিতে মেয়াদোর্ত্তীণ হয়ে যাবে। আমি বলছি পুরো প্রকল্প মানে পুরো লাতিন আমেরিকার কার্যক্রমের কথা । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গৃহ-উপসমিতি এক সপ্তাহ আগে এই কার্যকর্মের অবিরামতা বাতিল করে দিয়েছে।
কিন্তু সবসময় এমনই হয়ে এসেছে।কয়েকবছর আগে তুমি আমাকে বলেছ, প্রশাসন সবসময় কিছু স্বজনপ্রীতি করে এবং এভাবেই টাকা আসে।
মরিসন জানালার বাইরে তাকিয়ে তার মাথা ঝাঁকালেন, এবার না। আমি খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছি। এবার প্রশাসন আর এর পিছে ছুটবে না। তারা এবার আফ্রিকার উপর জোর দেওয়া সঙ্গত মনে করছে।
ধ্যাত। এটাই তবে কাহিনি। এখন বুঝতে পারছি তুমি ইউএসসি-এর কার সাথে দেখা করতে এসেছ। এটা সেই হাঁদারাম গ্রাহাম বেকার তাই না?
মরিসন কিছু বললেন না কেবল দূরের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
দনাহিউ আবার বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। বুঝতে পারছি এর কারণ হচ্ছে সে আমার চেয়ে বয়সে ছোট।
না, ইয়ান অবশ্যই না। তুমি তো জানোই বয়সটয়স ফালতু ব্যাপার, এগুলো কেবল কেমেস্ট্রি আর ফিজিক্সে প্রাধান্য পায়। আসলেই আফ্রিকাই এখন লক্ষ্য। লাতিন আমেরিকা পরিকল্পনা এই বছরই প্রচুর সুবিবেচনা আর মনোযোগ পেয়েছ এবং তথ্য বিষয়ক অভিজ্ঞ লোকজন এখন মনে করছে এবার আফ্রিকার দিকটায় মনোযোগ দেয়া উচিত।
ঠিক আছে। কিন্তু আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। মনে হয় না বেকার তোমার জন্য কিছু করতে পারবে। সে তো আর বিজ্ঞানী না।
মরিসন বললেন, সিদ্ধান্তটা আমার না। আমি বলছি তোমাকে এটা ঠিক না। আমি কোন কৌশল অবলম্বন করিনা। বিশ্বাস কর এটা মাঝে মাঝে আমাকে কষ্ট দেয়। আগামী বছর আমার বাজেটের দশ ভাগ কাজ ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়ে আছে ভাষাতত্ত্ব গবেষণার জন্য। বিশেষ করে আমেরিকানদের দ্রুত পদ্ধতিতে, সোমালি, বেম্বা, সোয়ানা, লুও এবং দিংকা ভাষায় শেখার কাজে।
অসম্ভব। আমার কাজ বাদ পড়েছে কিছু অপ্রাসঙ্গিক ভাষার অনিশ্চিত ব্যবহার শেখানোর জন্য। জন এই পৃথিবীতে যতজন মানুষ লিও ভাষায় কথা বলে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক লোক লস এঞ্জেলসে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে।
আমি তা জানি ইয়ান। অন্যান্যরাও এটা জানে। আমার তাদের কারো কারো সাথে যোগাযোগ আছে। এমন ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের লোকজনের তাদের অস্তিত্ব বাচাতে উপসমিতির বাতিকের উপর নির্ভর করে না। আমি তোমাকে কিছু পরামর্শ দেব।
মরিসন একটি কার্ড বের করলেন, আমার মনে হয় এটা তোমার জন্য সেরা জায়গা হবে। দা সিউল ফাউন্ডেশন। নাম শুনেছ নিশ্চয়ই।
দনাহিউ বলল, অবশ্যই।
মরিসন দনাহিউকে কার্ডটা দিতে দিতে বলল, আমি তোমার জায়গায় থাকলে এই লোকটাকে একটা ফোন করতাম। বেঞ্জামিন পোর্টারফিল্ড। লোকটাকে আমি বহুদিন ধরে চিনি। সে এখন সিউল ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট এবং ল্যাটিন আমেরিকার একরকম বিশেষজ্ঞ। আমি নিশ্চিত তোমার কথা শুনে সে খুশি হবে।
দনাহিউ কার্ডটা নিল। মোটা কালো অক্ষরে নাম আর ফোন নাম্বার দেয়া কেবল।
ধন্যবাদ। তুমি একজন সত্যিকারের বন্ধু। তুমি কি স্কেন্ডিয়ায় আমার সাথে রাতের খাবার খেতে যাবে। সেখানে আমি তোমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। একজন স্নাতক পাশ করা ছাত্রী যে আমার সাথে চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরিতে কাজ করছে। মেয়েটির নাম গ্রেস ওয়ার্নার।
মরিসন যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো, আমি পরে তোমার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলব। এখন আমি হোটেলে গিয়ে ঘন্টা দুয়েক বিশ্রাম নিব তারপর দেখব কার সাথে দেখা করা যায়।
মরিসন লিফট দিয়ে নীচে নেমে আসার পর ইয়ান দনাহিউয়ের ব্যাপারে চিন্তা করল। এক দু সপ্তাহের মধ্যে দনাহিউ হয়ত সিউল ফাউন্ডেশনের পোর্টারফিল্ডকে ফোন করবে এবং দারুণভাবে চমকে যাবে। সিয়ল ফাউন্ডেশন হয়ত এখন দনাহিউর গবেষণার মতো কাজে এর সবচেয়ে বড় অনুদানটা দেবে। বেন পোর্টারফিল্ডকেও দনাহিউর খুব ভালো লাগবে হয়ত। পঞ্চাশোর্ধ্ব শান্ত, ব্যবসায়ী ধরনের এই লোকই হয়ত দনাহিউর জীবনে প্রার্থনার উত্তরের মতো আবির্ভুত হবে। দৃশ্যটা মরিসনের কাছে যুতসই বলে মনে হলো। সিনেমায় একেই বিনিয়োগকারী বলা হয়, তাই না। কিংবা ফেরেশতা! যখন পোর্টারফিল্ড গুয়েতমালার প্রধান স্পেশাল অপারেশন অফিসার ছিল তখন গেরিলারা তার বাহিনির নাম দিয়েছিল এল এঞ্জেল দে মুয়েরতে। কিন্তু ইয়ান দনাহিউ তা জানতে পারবে না। যদি দনাহিউ পোর্টারফিল্ড সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে যায় তবে শুনতে পাবে সে একজন সম্মানিত ব্যবসায়িক প্রতিনিধি, একটি ছোট বিমান সংস্থার বিগত প্রেসিডেন্ট, একটি বৃহৎ খাদ্য প্রতিষ্ঠানের বিগত ভাইস-প্রেসিডেন্ট আর কয়েক বছর ধরে সিয়ল ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদ। তার পক্ষে কখনই জানা সম্ভব হবে না যে প্রতিষ্ঠানটা বছর বছর সিএই-এর গ্রাহক সংস্থা হিসাবে রূপান্তরিত হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা কেন্দ্রের সাথে লেনদেন করার ফলে অনেক বছরের কেন্দ্রীয় নিরীক্ষণ থেকে দনাহিউ হয়ত কিছুটা সময় মুক্তি পাবে। পোর্টারফিল্ডের ব্যক্তিত্বই অনেকটা মুক্তি। যে বেশ চতুর ও নির্লিপ্ত। দনাহিউ হয়ত ওয়াশিংটন থেকে আগত মধ্যবয়সী পরিদর্শককে দা বেভারলি ওয়িলশায়ারে সন্ধ্যা কাটানোর জন্য স্নাতক করা মেয়ে খোঁজার কাজ থেকে মুক্তি পাবে। মরিসন ভাবলেন, এই অংশটা দুঃখজনক। কিন্তু কিছু করার নেই। নির্দেশ অনুযায়ী লাতিন আমেরিকার কাজ এখন বাক্সবন্দি করতে হবে। এখন থেকে করদাতাদের থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে দনাহিউ গবেষণা হিসাবে জন্য কোন বরাদ্দ থাকবে না। একটি দীর্ঘ পারষ্পরিক সন্তুষ্টিজনক প্রক্রিয়ার সমাপ্তি হল। লস এঞ্জেলস কখনোই জন নক্স মরিসনকে এই সুবিধা দিবে না। যে লোকটা ল্যাংলেতে বসে এই নির্দেশ দিয়েছে সে কি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে ১৯৪৭ সালের হার্ভাডের বসন্ত থেকে এই পর্যন্ত চলতে থাকা মরিসনের যৌন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অংশ ধ্বংস করে দিচ্ছে সে। কাজগুলো দনাহিউ বেশ ভালো ভাবেই করত। মূলত আমেরিকার একজন বিচক্ষণ রমণ দূত দনাহিউ কিনা মরিসনের মতো সুরুচি, বীর্যবান, রসিক লোকের কাছ থেকে এমন একজনের কাছে হস্তান্তরিত হচ্ছে! পোর্টারফিল্ড এমন একজন মানুষ যে কিনা আরমাডিলো (কাঁটায় ঢাকা সুড়ঙ্গ খোঁড়া একটি প্রাণী) খেয়েছে। এতেই বুঝা যায় তার রুচি। সে দনাহিউর কোন স্নাতক পাশ গবেষণা সহকারীকে গ্রহণ করবে না। কারণ সে তার পিঠে ছুড়ির দাগের ব্যাপারে ব্যাখ্যা করার ঝামেলায় যাবে না। এই কিংবদন্তি পঞ্চাশ দশকের প্রথম থেকেই তার স্ত্রীর সাথে একটি সুখী জীবন যাপন করছে কিন্তু জন নক্স মরিসনের তা মনে হয় না। এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, পোর্টারফিল্ডের কোন মানবিক অনুভূতি নেই। একজন কম্যুনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক প্রতিনিধির মতো তার মন এবং রুচি। তার পেছনে দনাহিউর যুবতী ছাত্রীদের একরকম অপচয় হবে। খুবই দুঃখজনক।
(চলবে)