ফেরদৌস হৃদয় | কবিতাগুচ্ছ

জলের ভাবনা

জলকে মনে হয় সবসময় একটা কিছু নিয়ে ভাবে। প্রায়ই তার মাথা দুলতে দেখা যায় আর সে হাঁটে। বাতাসের সাথে তার প্রতিক্রিয়া লুকিয়ে রাখতে ভালোবাসে। চাঁদের মুখোশটা জলের উপর খসে পড়লে ভাঁজ করে রাখতে চায় নিজের বুক। জলকে যদি তার ভাবনা বিষয়ে বলেন—সে আপনাকে খুলে দেখাবে তার শরীরের যাবতীয় কলকব্জা। মাথা, উরু আর পায়ের আঙুল পর্যন্ত—প্রবাহ,আর প্রবাহ। তার ভাবনা বলতে এই যে, বয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়—কিচ্ছু নয়।

পাখিরা চক্রাকারে

মেঘের যোজন-বিয়োজন দেখি, ভাবি
পৃথিবীর যাপন থেকে সবকিছুর জন্ম
পুনরায় মোল্টিং,সূর্যনিসৃত রস
বালিয়াড়ির বিচিত্র আকারে জীবন…
তবু ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌনতা তুচ্ছ কিছু নয়
কিছুই নয় তুচ্ছ বেল্ট, বেলুন, জরি, পুতুল
কিংবা দুধের সর যেন শীতল লাভার মতো আদিম
স্পর্শ নেই তুচ্ছ দালানের কাঁচে তবু মেঘ আঁকা
ডালের ঊর্ধ্বমুখি অবচেতন শাখাময়…
পানা আর জলের অভিন্ন শরীরে স্বেদ-ঘাম
পতাকার ঠোঁট চুষে নিচ্ছে বাতাস…
বিচূর্ণ শিলালিপি সারি-সারি উড়ছে বালির কেশর
উড়ছে পাখিরা চক্রাকারেই উড়ছে
আমিও উড়ছি হৃদয়ের অনেক পরিধি… স্তর…

এই ঘরে

ক্রমান্বয়ে গলে গলে
কোথা থেকে আসে এত অন্ধকার
বাতাসের স্বচ্ছ-কালো আঁইশ চুয়ে চুয়ে…

কোনোকিছু নিশ্ছিদ্র নয়।
ক্রমান্বয়ে গলে গলে এত অন্ধকার এই ঘরে
কোথা থেকে আসে…
সবকিছুই মিশ্রিত এখানে অদ্ভুত অনুপাতে…
কোনো কিছু আলাদা নয়,আলাদা করা যাবে না কিছুই
দানা-দানা কফির মতো এই দেহ পড়ে আছে
জ্বর সেরে গেছে, তবু শরীরে পচা মাংসের গন্ধ…

শুশুক বাতাস

সন্ধ্যায় বটগাছকে আরও বিনয়ী মনে হয়

দীর্ঘ পথ ফেলে এসে এখানে দেখি পাতার পতন
আমারই মতো ঘুরে ঘুরে
পাড়ি দিচ্ছে বিস্তার… প্রান্তর…
বাতাসের কুঁজো পিঠে।

কোকুনের ভেতর এই পাথরখণ্ডের ডানা গজাবে একদিন

কিছুই নড়ছে না কোথাও, না কোথাও কিছুই না
বুকভর্তি শ্বাস নিয়ে এইমাত্র শুশুক-বাতাস জলে ডুবে গেছে…

ভার বোধ করি

এই জলাশয়কে পিষে দিচ্ছে পাড়ের চোয়াল…

মেঘের শিরায় শিরায় জলপথিক…
মেঘ-মরুভূমি থেকে উড়ে আসছে বৃষ্টিবালু
কিংবা মেঘকল থেকে ছাঁটাচাল
গুড়ি গুড়ি। দূরে বসে আছে মৃতবাঁশে যে পাখি, বুকে তার ভার বোধ করি। আর বৃষ্টির ছাঁট আমাকে একলা ক’রে। একলা করে দিয়ে সূর্যের মুখ থেকে মুছে দিচ্ছে লালা-রক্ত…

নামহীন ১

ঝিঁঝির চিৎকারে ঢুকে যেতে চাই
আলো…
এখানে অসংখ্য ঘাস
একটি ঘাসের কাছে যেতে চাই
আর অসংখ্য জলকণা
একটি কণার কাছে পৌঁছতে চাই
সশরীরে। উত্তাপ… স্পর্শ… আচরণ…
ও চিৎকার
ও ঘাস
ও জলকণা
আমি শাখা। বজ্রপাতের বিদ্যুৎ। নিভে যাই খুব।
আমি বাতাসের সব প্রত্যঙ্গ ছুঁই
আমি জলের সমস্ত অঙ্গ ধুই। যেমন উরু।
ছুঁই আর ধুই
ধুই আর ছুঁই
মাছের ফুলকা—
ক্লোরোফিল—
জলমগ্ন শামুক—
আমি দেয়ালে ঠেসে বসা আলো
ঘুমাই। ঘুমোতে ঘুমোতে আলোর হাড়
বেড়ালের থাবা আমি জলের আকার
ভেঙে পড়া বিস্কুটের গুঁড়ো…

আমিই পোকাদের ডাক, তুমি শুনেই থাকো

নামহীন ২

কী ক্রিয়ায় আমায় দ্রবীভূত কর দ্রব?
এই ভেসে উঠি—এই ডুবে যাই
এই পথ এই হর্ন—গাড়ি আমি জানি
ভুলে যাবো যেরকম জীবনের অনেক উত্তাপ ভুলে গেছি আর ভুলে গেছি বৃষ্টির পায়ের অনেক ছাপ

কী ক্রিয়ায় আমায় দ্রবীভূত কর…

নামহীন ৩

মাঝে মাঝে কিছু দৃশ্য খুব পরিচিত লাগে
আগেই দেখা কোনো দৃশ্যের মতো
তার হাত পা মুখ চোখ…
আমার শরীরের ভেতর হুবহু সেই দৃশ্য
ভ্রুণের মতো অবচেতনে থাকে
আর কি ভেবে হঠাৎ সে জাগে
সুস্থির বোধের দেয়ালে মৃদু আঘাত করে

মাঝে মাঝে কিছু দৃশ্য খুব পরিচিত লাগে

নামহীন ৪

অবিরল কথা বলে সে
অবিরল কথাগুলো বাতাসের ধুলোর সাথে মেশে
যেভাবে শরীর মেশে, মিশে যায়…
যেভাবে লিখিত নাম গাছের মাংসে ঢেকে যায়

সেভাবে অবিরল কথাগুলো বাতাসের শিলায়
চাপা পড়ে

যখন অবিরল সে বলে কথা
শব্দে শব্দে রক্তের ঘাম আর অবচেতনের ঘ্রাণ
লেগে থাকে

অবিরল কথারা কোন গভীর থেকে আসে?
সেই উৎসস্থল…

তীরন্দাজ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক অনলাইন পত্রিকা

Edtior's Picks

Latest Articles

Copyright 2022 – Teerandaz

http://www.pixelsdigital.netDeveloped by Pixels Digital