১
তুমি ট্রেইলে যাবে?
ট্রেইলে? মানে,,মানে?
না, মানে আমাদের এখানে কাছেই একটা ট্রেইল আছে ত, হিউরন নদীর ধার দিয়ে দিয়ে। যাবে?
এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা। ভাই , ইয়ার্কি না। নদীর ধারে বিকেলে ঘুরতে গেলাম দেবু ও তনিমার সঙ্গে। দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও তনিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ওরা থাকে মিশিগানে। তনিমা মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে। কাছেই ডেট্রয়েট, যেখানে গাড়িশিল্পের ধ্বংসাবশেষ এখন, জ্যান্ত গাড়ি কোম্পানিদের বিশাল বহুতলের পাশাপাশিই।
তবে ওরা ত থাকে গ্রামে। অ্যান আরবরে। বিলাসবহুল, মধ্যবিত্ত উচ্চমধ্যবিত্তের বাড়িঘর যাকিছু সুখের, আরামের, তা সব বড় শহরের “ডাউনটাউন” থেকে অনেক দূরে। গাড়ি চালিয়ে কিলোমিটার ছয় সাতেক গেলে তবে কাজের জায়গায় পৌঁছনো যায়। অন্যথা পাখির ডাক, কাঠবেড়ালির খুটুরখাটুর এসব নিয়ে, পর্চে এসে পড়া লালচে মেপল পাতার হেমন্ত, সাদা তুষারপাতের শীতকাল নিয়ে ওরা থাকে।
আর, ছুটিছাটা পেলেই ট্রেইলে যায়। ভালবাসে ট্রেইল। নিকটবর্তী বলতে ঐ হিউরন নদীর ধার। একেবারেই ঘন গাছপালা জঙ্গল এখানে। কাঠের ছোট ছোট সেতু, বিশেষ যত্নে রাখা কাঁচা পাকা রাস্তা, দুধারে স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক গাছপালা রাখার চেষ্টা হয়েছে। এই হল গে ট্রেইল। ছোটদের খেলার জন্য একটা ছড়ানো গড়ানো বেড়াহীন পার্ক, বেঞ্চি মাঝে মাঝে। হাঁস চরছে, পাখি উড়ছে। লাল বুকের রবিন, অথবা লাল ডানার জ্যে পাখি।
হাঁটার পথে কোন বেঞ্চি উতসর্গীকৃত কারোর মৃত ছেলে বা মেয়ের নামে। পাথরের ওপর লোহার ফলকে তার নাম। কারোর বা নামের সঙ্গে দু কলি কবিতা। মিশিগানের শান্ত শীতল জঙ্গল, অতি যত্নে রক্ষিত। প্রাণে ঠাণ্ডা আঙুল বুলিয়ে দেয় তা। উইকেন্ডে বাবা মা যায় বাচ্চাদের নিয়ে, ঝুড়িতে আপেল ও স্যান্ড উইচ প্যাক করে নিয়ে, সারাদিনের পিকনিকে, এইসব ট্রেইলে।
আরিজোনার ফিনিক্সে মিশিগানের মত শীতল আবহাওয়া নয়, মার্চ মাসে। সে সময়টা রোদ্দুরে স্নাত, হাওয়া শীতল হলেও, চড়া রোদে বেরুলে গ্রীষ্ম বলেই মনে হয়।
ট্রেলটা গোটাটাই পাহাড়ে। আপিসে পর সবাই গাড়ি রাখছে আর হয় গাড়ির মাথা থেকে সাইকেলটা পেড়ে নিয়ে বাইকিং করছে, নয়, হাঁটাহাঁটি। পোষা কুকুর সঙ্গে আছে কারুর। কারুর আছে ছেলে বা মেয়ে। পাহাড়ে চড়ো। দেখ চারিপাশে অসংখ্য হাত তোলা মানুষের মত, কিন্তু মানুষের তিন গুণ আকার সাউয়ারো (বানান অনুযায়ী পড়লে সাগুয়ারো) ক্যাকটাস বৃক্ষ। ছোট ছোট বদমাইশ বাচ্চার মত বা গুঁড়ি মারা খোক্কসের মত ক্যাকটাসের ঝোপ, অসংখ্য বুনো ঝাড়, হলুদ সাদা ফুল ফুটে ওঠা নানা ধরনের ঝোপ আসেপাশে আলো করে আছে। পাথরের চট্টানে পড়ে বিকেলের সোনালি রোদ্দুর ঝলকে উঠছে। শুষ্ক ঠাণ্ডা চমৎকার বাতাস বসন্তের। আর কদিন পরে ভয়ানক গরম পড়বে, উষ্ণতায় ফুটি ফাটবে। জল, জল করে অস্থির হবে তুমি। তবু সন্ধে সাতটা, সাড়ে সাতটা, আটটা, নটা অব্দি সূর্য থাকবে এই উত্তর গোলার্ধে। অফিসের পর এসে যতখুশি শরীরচর্চা কর, পকেটে জলের বোতল রেখে অবশ্যই।
স্যান এঞ্জেলোর ট্রেল আবার ঈষত উচ্চাবচ, কিন্তু পাক দিয়ে আছে লেককে। এই হ্রদ শহরের মধ্যে একমাত্র জলা জায়গা। পরিচ্ছন্ন জল। চিকচিক করছে। পাশ দিয়ে দীর্ঘ সাপের মত পাকিয়ে আছে পাকা রাস্তা। লেকের ধারে ধারে প্রাইম প্রপার্টি অনেক আছে। সেসব বাড়ির লোকেরা এ রাস্তায় গাড়ি চালালেও, দিকে দিকে নোটিস দিয়ে বলা আছে, এখানে রাইট অফ ওয়ে দিতে হবে জগার বা হাঁটিয়েদের। প্রত্যহ সন্ধ্যায় এই ট্রেলের মুখেও বড় পার্কিংয়ে গাড়ির সারি। মানুষ স্বাস্থ্যোদ্ধার করতে ঢুকে পড়ছে সে পথে।
ফিনিক্স, স্যান এঞ্জেলো এবং অ্যান আরবরের পর, বস্টনে গিয়ে যেই না আমাদের গৃহকর্তা ট্রেইলে যাবার উল্লেখ করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে না না, আমাদের ট্রেইল দেখা হয়ে গেছে বলে চেপে গেলাম। এখনো বরফ গলছে গত সপ্তাহের বরফ ঝড়ের, দিকে দিকে ভেঙে পড়ে আছে গাছ। এই কর্তার বাড়িতে দুটি ক্যানো রাখা। নদীতে রেগুলার যান গ্রীষ্মকালে ক্যানুইং করতে। আপাতত ট্রেইলে গিয়ে এক ঘণ্টা হেঁটে জমে টমে যেতে পারি। ভেবে শঙ্কিত আমি।
২
পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি – এইসব কবিতা আমাদের আছে বৈকি, তবে রবিবাবু কীভাবে গিয়েছিলেন জানা নেই। ২০১০-এর নির্মীয়মান ফোর লেন রাস্তায় গৌহাটি থেকে শিলং যাওয়ার দুঃসহ যাতনা বোধ হয় তখন রবি ঠাকুর দেখেননি। ইদানীং উড়িষ্যায় দারুণ হাইওয়ের সফর করি, প.ব. খুব পেছিয়ে ছিল, একটু ভালর দিকে এখন হাইওয়ের অবস্থা। যেটা আমাদের নেই সেটা হাই ওয়ের কালচার। ধাবায় ধর্ষণ হয়, মদের ঠেক তুলতে হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্ট করতে হয়। বাথরুম নেই বলে জল খাওয়া বন্ধ রাখতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
গোটা একটা বিশাল উপমহাদেশের প্রতি রাজ্যে সমস্তরের ফেসিলিটিতে কেয়াবাত কেয়াবাত বলতে ইচ্ছে হল আবার। আমেরিকার সুবিশাল তিন তিনটে দক্ষিণ প্রদেশের মধ্যে দিয়ে গাড়িতে ঘোরার অভিজ্ঞতায় এই জিনিসটাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার।
আমরা শুরু করলাম টেক্সাস থেকে, এবং যাবার পথে থেমে থেমে নিউ মেক্সিকোর সান্টা ফে-তে দু রাত কাটিয়ে, ঐতিহাসিক রুট সিক্সটি সিক্স হয়ে, গ্রান্ড কানিয়ন দেখে, আরিজোনার ফিনিক্সে পৌঁছে থামলাম। এ পথ ১০৫৪ মাইল মত। ফেরার পথে আবার ফিনিক্স থেকে টানা পনেরো ঘণ্টা চলে টেক্সাসে স্যান এঞ্জেলো। প্রতি দু তিন ঘণ্টা অন্তর গ্যাস স্টেশনে থামা, মাঝারি থেকে খুব পরিষ্কার রেস্ট রুমে জলবিয়োগ, কয়েক গ্যালন গ্যাস ভরানো গাড়ির ট্যাঙ্কিতে, সুপারমার্কেটের মিনি ভার্শান গ্যাস স্টেশনের সুখাদ্য ও কোকাকোলা দিয়ে জলযোগ… দু তিন ঘণ্টার বিরতিতে গাড়িতেই হাতে হাতে খেয়ে ফেলা সঙ্গে নেওয়া নানা মুখরোচক খাদ্য… এইরকম চলল। ক্রমশ অভ্যেস হয়ে আসে গতি। যারা চালাল, দিদি আর জামাইবাবু, জানিনা চাপ নিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে বলেই কিনা, তারাও ত সানন্দেই এ কাজ করল, যদিও অল্প ভাগাভাগি করে। দায়িত্বহীন ক্ষমতা নয়, বেশ কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হয়। রাজ্য থেকে রাজ্যে বদলে যাওয়া স্পিড লিমিটের নিরিখে গাড়ির স্পিড ঠিক রাখা, ম্যাপ দেখা, ড্রাইভারের পাশের সঙ্গী হয়ে বসে ঘুমিয়ে না পরা, চোখ কান খোলা রাখা তৎপরতা, এসব ত জরুরি বিষয় নিশ্চয়ই। আমি ও আমার মেয়ে শুধু ব্যাক সিটের প্যাসেঞ্জার। উপভোগটুকুই আমাদের সঞ্চয়ে রয়ে গেল।
হাইওয়ে বিষয়টাই, ওই আর কি, স্টেট লাইব্রেরির মতই, আমেরিকার আর একটা জিনিস যা আমাকে টানে। সত্যি আমেরিকায় যদি চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া কিছু থেকে থাকে তো তা এই অসংখ্য সুন্দর সুন্দর রাস্তা দিয়ে গোটা আমেরিকাটাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলাটাই। উন্নতি। প্রগতি। বিজ্ঞান। নানা শব্দে এই প্রথম বিশ্বের দেশটার কীর্তিকলাপ ত বর্ণনা করা হয়। সবকিছুর মূর্ত প্রতীক যেন এই লম্বা লম্বা হাইওয়েগুলো। এত ঝকঝকে ইস্পাতের ফলার মত তাদের চেহারা, তাদের গঠনে নানা দেশ থেকে আসা ইঞ্জিনিয়ারদের অবিরত মাথা ঘামানোর প্রমাণ।বড় বড় ইন্টারস্টেট হাইওয়ে একটার পর একটা তৈরি হয়েছে ১৯০০-র আশপাশ থেকে শুরু করে।
এই লম্বা সোজা সোজা রাস্তাগুলো ধরে অনেকদূর চলে যাওয়া, লং ড্রাইভ। এর একটা নেশা আছে। আর আছে পেঁচানো, গোল করে বানানো একজিটগুলো, যেগুলো যে কোন জনপদের কাছাকাছি আছে, প্রয়োজনে হাইওয়ে ছেড়ে জনপদের দিকে যাবার জন্য। আকাশ থেকে পাখির চোখে দেখলে ফুলের মত দেখতে যেন, ফিতে দিয়ে বানানো বিনুনির ফুল।
ব্যস্ত জনপদের পাশ দিয়ে যখন চলে যায় সেই ইন্টারস্টেট, তখন তার জন্য বেশ কিছু একজিট লাগে। হাইওয়ের দ্রুতগামী গাড়ির সারি কোনভাবে ব্যাহত হবে না, বাঁ পাশে ডানপাশে বেরিয়ে যাবে ফ্যাকড়া রাস্তা, যা দিয়ে শহরের গাড়ি ঢুকবে হাইওয়েতে, কিন্তু দ্রুতগতির গাড়িদের স্লো ডাউন করতে হবে না, আবার কোন শহরে যেতে গেলে বেরিয়েও যেতে হবে ফ্যাকড়া দিয়েই কারো অসুবিধা না ঘটিয়ে। অনেক সাইনবোর্ড লাগানো থাকে হাইওয়েতে। প্রতিটা জাংশনের আগে বুঝিয়ে দেওয়া থাকে কোনদিকে যেতে গেলে গাড়িকে তুমি কোন লেনে নেবে। একেবারে মাঝে লেনগুলি থ্রু যাচ্ছে। এপার ওপার হয়ে যাচ্ছে সব জাংশন অতি দ্রুত।
এবার আসি পথের পাশের দৃশ্যগুলোর কথায়। টেক্সাস থেকে নিউ মেক্সিকোর রূপ, নীল চকচকে আকাশ আর হলুদ গমের বা ভুট্টার ক্ষেতের সীমাহীন বিস্তার। ভ্যান গঘের আঁকা ছবিও মনে পড়তেই পারে। তবে বেশি গা ছমছম করছিল হিচককের ছবি নর্থ বাই নর্থ ওয়েস্টের সেই শুনশান রাস্তা আর গমের ক্ষেতের সিকোয়েন্সের কথা মনে পড়ে। ছোট প্লেন নিয়ে কেরি গ্রান্টকে তাড়া করার দৃশ্যটা ভেবে। সে দৃশ্য নাকি ক্যালিফোর্নিয়ায় শুট করা হয়েছিল। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় হলুদ মাঠ সোনালি। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, অলক মেঘের অবাস্তব দৃশ্য।
আবার নিউ মেক্সিকো থেকে যখন আরিজোনার দিকে যাওয়া, নানা ধরনের আকৃতির বহু প্রাচীন পাহাড়ের ফর্মেশন দেখতে দেখতে পথ চলা। আশপাশ থেকে শুরু করে নানা ধরনের ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের বাসভূমি অসংখ্য ছোটবড় পাহাড়ে সাজানো এই পথ।
আর রাত্রি হয়ে এলে, আকাশে অগণিত তারার ঝকমকিয়ে থাকা, স্পষ্ট দেখতে পাওয়া কালপুরুষের কোমরবন্ধ কালপুরুষের সঙ্গের কুকুরটি।
পৃথিবীর সব দেশ, মানুষ, পথ… কালপুরুষের কাছে সমান।
৩
রেশম পথের কথা ত আগেই বলেছিলাম, যখন উজবেকিস্তানে আমির তিমুর অর্থাৎ দুর্দম তৈমুর লং-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। পুব আর পশ্চিমের মধ্যে একটা সুতোর মত পথ। একদিকে চিন, চিনের অসামান্য সব রেশমের কাপড়, যাকে ভারতীয়রা চিনাংশুক বলে ডাকে। অন্যদিকে আরব দুনিয়া, তুর্কিস্তান। আজ ইউরোপ বলে লোকে যাকে জানে সেই পর্যন্ত পথ চলে গেছে পশ্চিমে। সুগন্ধি আতর আর মশলা আর মধু আর হাজারো সামগ্রীর কেনাবেচা চলে। ভারতীয় বণিকেরা তাদের মহার্ঘ পাথর গয়না সোনা দানা আর কাপড় নিয়েও আসছে যাচ্ছে এই পথেই। এই পথ গোটা এশিয়াকে বেঁধে ফেলেছে যেন পুব পশ্চিম বরাবর।
ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। মরুভূমির ভেতর দিয়ে এঁকে বেঁকে চলেছে যাযাবরের মত, ব্যবসায়ীদের ক্যারাভান। উটের সারি, সমরখন্দের বিখ্যাত তেজি ঘোড়াদের দল, আর একটু ধীরগতি গাধা খচ্চরের সারি। তাদের পিঠে পশরা নিয়ে সেই কোন দূর ভূমধ্যসাগরের তীর থেকে, নানা দেশের ব্যবসায়ী চলেছে। গায়ে তাদের আলখাল্লা। তুর্কি থেকে চিনের দিকে চলেছে একদল ব্যাপারি, চামড়া, খুব দামি আতর, পশম রুপো আর অম্বর-সুগন্ধী নিয়ে। আরব ব্যাপারিদের শরীরে খুব বল, খেজুর খেয়ে খেয়ে চামড়া উজ্জ্বল বাদামি। গায়ে অসম্ভব জোর। ভারতীয়রা আসে, সুতির সূক্ষ্ম কাপড় আর তামা সোনা আর রুপোর মত মহার্ঘ ধাতুর তৈরি জিনিশ নিয়ে। তাদের গায়ের রঙ বাদামি, চোখ মুখ সুন্দর। আর চিন থেকে ব্যাপারিরা আসে রাশি রাশি রেশম নিয়ে, চা চিনি নুন মশলা নিয়েও। আরো ছোট আর সুন্দর আর দামি জিনিসও থাকে তাদের কাছে। মূল্যবান মণিমুক্তো, কস্তুরী আর বাঘের হাড়। পাখির পালকে সাজানো টুপি। আর সাদার ভেতর নীলের কাজ করা, নানা রঙ দিয়ে আঁকা চিনেমাটির অপূর্ব বাসনপত্র নিয়ে আসছে টানা টানা চোখের, গোল মসৃণ মুখের হলুদ চামড়ার অনেক ব্যবসায়ী।
একদিকে সমরখন্দ, অন্যদিকে বাবরের জন্মভিটে বুখারা। আর এইদিকে তাশকেন্ত। সমরখন্দে আমির তিমুর, যাকে ইতিহাস জানে তৈমুর লংগ বলে, সেই তৈমুর লং বানিয়েছিল অনেক অনেক সুন্দর মসজিদ আর এবাদতখানা। নীল পাথরের কারুকাজ করা সেইসব এবাদতখানা আর প্রার্থনার স্থলগুলোর প্রতিটায় যে ঝকঝকে ফিরোজা রঙ আর গাঢ় নীল রঙের মিশেল আছে, ছোট্ট ছোট্ট পাথরের যে সব অদ্ভুত জ্যামিতিক কাজ আছে, সেগুলো সব বানানো হয়েছিল ইরানি তুরানি ইস্পাহানি কারিগরদের দিয়ে। ইরান ইরাক সব জায়গায় ঐ কাজ আছে। সূক্ষ্ম কাজ যেন কাগজ ভাঁজ করে সাজানো, আসলে পাথরের কিংখাব সব। বহু বছরের জন্য রেখে দেওয়া।
সমরকন্দের হলুদ বালিতে এই যে অদ্ভুত নীল নীল জলাশয়ের মত মসজিদ, মাদ্রাসা আর এবাদতখানা জেগে আছে, এ জায়গাটাকে বলে তৈমুর লঙের স্বপ্ন।
স্বপ্নই তো বটে। মরীচিকাও বটে। হলুদ মরুভূমির বালি তেতে গিয়ে বাতাস হালকা হয়ে গেলে চোখের সামনে ভোজবাজির মত নড়ে চড়ে ওঠে, কেঁপে ওঠে যে সব আকার, ভূতুড়ে সব ছায়া, মনে হয় দূরে জল চিকচিক করছে, ঘোড়ায় চেপে দিকদিগন্ত দাপিয়ে বেড়ানো উজবেকদের মনে হঠাৎ বিভ্রম হয়, কী যেন কী হুরিপরির যাদুতে মরুভূমির মাঝে হঠাত এসে গেছে জল… তেমনি, ঐ নীল কাজ করা অদ্ভুত ইমারতগুলোকে দেখলেও মানুষ হকচকিয়ে যাবে, যাবেই। মনে হবে এই হলুদ মরুভূমির মধ্যে কোথা থেকে এল জল! কোথা থেকে এল এত চোখ জুড়নো নীল নীল নীল। এ কী স্বপ্ন, এ কী মায়া! এ কী মরীচিকা!
নাহ্, কাছে গেলে দেখা যাবে সব বড় বড় ইমারত, বিরাট বিরাট গম্বুজ আর থাম আর তোরণদ্বার, তার ভেতরের জালের মত বিছিয়ে থাকা দারুণ সব নীল পাথরের ঝিকিমিকি কাজ, এগুলো একটাও স্বপ্ন নয়, সত্যি। একেবারে হাতে ধরে দেখার মত সত্যি।
সেই পথেও আমি গিয়েছিলাম একদিন, তবে মরুশহরের দিকে যেতে তাশখেন্ত থেকে ব্যবহার করেছিলাম রেলগাড়ি। আফ্রাসিয়া নামের সাদা ধবধবে মরালীর মত সেই রেলগাড়ি। বিলাসবহুল।
তরমুখ , খরমুজা আর বাদামে ভরা ছোট ছোট সব স্টল পেরিয়ে সেইসব রেশমি শাল, স্কার্ফ আর মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গাধায় চড়া মূর্তির দোকান। পশরা সাজানোর ভঙ্গিটি যেন অনায়াসে হাজার দু বছর আগের মতই। এ পথে আমি যে গেছি বার বার। মনে হবেই হবে।
পূর্বজন্মের স্মৃতি জেগে উঠবেই।