ঘুপচি গলির গল্পে থেমে না থাকা শহীদুল জহির

Shahidul Jahir

ভূতের গলির লোকেরা ব্যস্ত থাকে কী নিয়ে বলুন তো? আরে হ্যাঁ, পুরান ঢাকার ভূতের গলির কথা বলছি। ঐ যে বলে না, ইংরেজরা বুটের গলি বলতো সেখান থেকে আস্তে আস্তে নাম হয়ে গেছে ভূতের গলি? আভিজাত্যের ছোঁয়া লাগা নতুন ঢাকা থেকে খানিক দূরে পুরান ঢাকার ভূতের গলির বিভিন্ন টানাপোড়েনে ঢোকার আগে শহীদুল জহির জানিয়ে দিচ্ছেন সেখানকার লোকেরা আসলে কী করে।

‘ভূতের গলির লোকেরা বানর নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তারা দেয়ালের উপর অথবা দূরে ছাতের কার্নিশে লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকা এই খয়েরি রঙের জানোয়ারের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে, বান্দর বান্দর, ওই যে বান্দর!’

পুরান ঢাকার বিভিন্ন ঘুপচি গলিতে ঘুরে ঘুরে সেখানকার টানাপোড়েন নিয়ে গল্পকার হিসেবে জীবন দেখাতে চেয়েছেন বারবার। কিন্তু বিভিন্ন ঘুপচি গলিতে আটকে থাকতে পারেননি তিনি। কারণ জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে লিখতে গেলে কখনই হয়তো কোন গলির লোকদের নিয়ে আটকে থাকা যায় না। যেমন মহল্লার লোকেরা যখন বলে যে, ভূতের গলিতে আগেও বানর ছিলো, এটুকু দেখার আগে শহীদুল জহির আমাদের দেখায় আরও দীর্ঘ বাক্য।

শহীদুল জহির। ছবি: সমকাল

 শহীদুল জহির আমাদেরকে যখন ভূতের গলির লোকেদের বানর নিয়ে ব্যস্ত থাকার দৃশ্য দেখাচ্ছেন ঠিক এরকমই দুটো বাক্যের মাঝে জুড়ে দিচ্ছেন প্রায় ৯৭ শব্দের কাছাকাছি দৈর্ঘ্যের এক বাক্য। যাতে আমরা দেখতে পাই, ঘুপচি গলি থেকে বেড়িয়ে একাত্তর সনের মুক্তিযুদ্ধ, রাতের ঢাকা, গুলির আওয়াজ এবং নীরবতা সঙ্গে দেখতে পাই ভূতের গলিতে নেমে আসা একাত্তরে আবদুল হালিম নামের কেউ একজনকে খুঁজে না পেয়ে তার জননী বিলাপ করেন আবার নীরবে কাঁদেন, যার কারণে মহল্লার লোকেরা তাঁর এই কান্নার শব্দ আসলে শুনতে পাচ্ছে নাকি শুনতে পাচ্ছে না, তা ঠিক ধরা যায় না। এ যেন ঘুমচি গলিতে গল্প নিয়ে থেমে থাকতে না পারা এক শহীদুল জহির

‘একাত্তর সনের ঘটনা ২ মার্চের পর থেকে যখন দেশে ঘটতে থাকে, যখন রাতে ঢাকা শহরে কার্ফ্যু জারি করা হয়, টিপু সুলতান রোড দিয়ে ছুটে যাওয়া ভারী মিলিটারি গাড়ির চাকার গোঙানি এবং গুলির ফটফট আওয়াজ নীরবতাকে বিদীর্ণ করে, এবং ২৫ তারিখের রাতে নয়াবাজারের কাঠের গোলা পুড়তে শুরু করে তখন ভূতের গলি তার বাইরে থাকে না; ভূতের গলিতেও অবধারিতরূপে একাত্তর সন নেমে আসে এবং তখন আবদুল হালিম এই সময়ের পাকচক্রে ধরা পড়ে; আহা রে আবদুল হালিম, আহা রে আমার পোলা, বলে তার মা হয়তো কাঁদে, নীরবে বিলাপ করে, মহল্লার লোকেরা হয়তো এই কান্নার শব্দ শুনতে পায় অথবা পায় না’।

সেকেন্ড হেডিং

শহীদুল জহিরের মত আক্ষরিক অর্থেই নিভৃতে থাকা লেখকের গল্পের শক্তির দেখা পাই তার লেখক জীবনের সুচনাতেই। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত ‘ভালোবাসা’ গল্পে বাবুপুরা বস্তিবাসী এক দম্পতির প্রণয়ের গল্প তৈরি হয়েছে। কিন্তু গল্পের চুড়ান্ত বিষয় একটি ফুলকে কেন্দ্র করে। গল্পের মুল চরিত্র হাফিজদ্দি বস্তির নোংরা ঘরে বেমানানের মত একটি ফুল নিয়ে এলেও, খানিক সময়ের মধ্যে তার সহধর্মিনী আবেদা ও তার সদ্য কিশোরী কন্যার ভেতরেও ফুল নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু এই ঘরের কর্তা হাফিজদ্দি ফুলের মধ্যে চুল দেখতে পেয়ে যখন বুঝতে পারে এই ফুলটি তার অগোচরে নিজের চুলের মধ্যে গুজেছিলো তারই বউ আবেদা, তখন তার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মত বিপরীত দুটো দৃশ্য জন্ম দেয়। ফুল নষ্ট হবার জন্য তার বড় রাগ হয়, আবার খানিকটা অভিজাতদের দৃশ্যকল্পের মত চুলে গুজে থাকা ফুল ভেবে তার মনটা অন্যরকম হয়। এই দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে ভুগতে হাফিজদ্দি সিদ্ধান্ত নেয় ফুলটা সে আর রাখবে না, দিয়ে দেবে চুলে গুজে রাখার জন্য।

হঠাৎ হাফিজদ্দি বলে, ফুলটা তরে দিয়া দিলাম, যা।

কথাটা এত আকস্মিকভাবে আসে যে, আবেদা চমকাবারও সময় পায় না। বলে, কী করুম আমি অইডা দিয়া?

তর যা মনে লয়।

হাফিজদ্দির গলায় কোনো বাহুল্য কোমলতা ছিল না। আবেদারও সময় ছিল না তক্ষুনি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসার। তবু আবেদার বুকের ভেতরটা কেঁপেছিল কী এক সুখে। হঠাৎ-ঝরা বৃষ্টির পর পোড়া চরাচরের মত আবেদার মনে হয় কী আরাম বৃষ্টির এই অনাবিল জলে ভেজায়’।

আমরা পাঠকেরা দ্রুত বুঝে ফেলি বাবুপুরা বস্তিতে গল্পটির প্রেক্ষাপট তৈরি হলেও সেটি আর উক্ত স্থানে থেমে থাকে না। চরিত্রের গভীরতার কারণেই হোক কিংবা অস্তিত্বের নিরন্তন টানাপোড়েনের কারণেই হোক, বস্তির ঘুপচি কোন ঘরে গল্পকে থামিয়ে রাখতে পারেন না গল্পকার নিজেই।

আমরা যদি একটি স্থান বা ঘুপচি গলির প্রসঙ্গ কিছুক্ষণের জন্য খানিকটা উহ্যও রাখি, তবে আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয় শহীদুল জহিরের গল্পে নর-নারীর প্রেম ভাবনার অন্যরকম অভিলাষ। তিনি গল্পে যেমনি ভাবে এনেছেন বিবাহিত দম্পতির প্রণয়ের চিত্র, তেমনি মাঝে মাঝে কোন পুরুষের চোখে নারীর প্রতি চাহুনিতে ছিটিয়ে থাকা প্রেম। তাশরিক-ই-হাবিবের লেখা ‘গল্পকার শহীদুল জহির’ গ্রন্থে এমন বক্তব্যই দেয়া হয়েছে- ‘নিত্যদিনের যাপিত জীবনে ব্যক্তিহৃদয়ে প্রস্ফুটিত প্রেমের দুর্লভ মুহুর্তগুলো কখনো স্মৃতির জগৎ থেকে বারবার হাতছানি দিয়ে তাকে কীভাবে বর্তমান থেকে হারানো অতীতের মোহময় ভূবনে নিয়ে যায় জাদুকরী সম্মোহনের মতো, প্রেমের এমন অসাধারণ চিত্রও তাঁর গল্পে প্রতিপাদ্য হয়েছে। এমনকি সমাজে প্রচলিত অনুশাসন-সংস্কারের শৃঙ্খলকে অবলীলায় অতিক্রম করে উঠতি বয়সের তরুণের প্রতি সৌন্দর্যবর্তী বিধবা যুবতী নারীর দুর্বার প্রণয়াবেগের সাবলীল ও বিশ্বস্ত রূপায়ণেও তিনি স্বচ্ছন্দ। কখনো বা নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি ব্যতীতই অন্তরে নিছক একবারের উপলব্ধি যে তাদেরেকে প্রেমের পথে অগ্রসর করতে পারে, এমন অধরা বা বিমূর্ত মনোভঙ্গির প্রতিফলনও শহীদুল জহিরের গল্পের নায়ক-নায়িকার আচরণে পরিদৃষ্টমান। সর্বোপরি, মানব-মানবীর পারস্পরিক বোঝাপড়া ও একের প্রতি অন্যের আস্থা, নির্ভরতা, বিশ্বাস, ও বন্ধুত্বপূর্ণ সমঝোতার সমান্তরালে প্রেমের অতৃপ্তি ও আক্ষেপ, বিরহের তীব্র হাহাকার, সংশয়, বিকার ও ঈর্ষান্বিত মানসিকতার সমন্বয়ে তাঁর গল্পসমূহ বাস্তবতার শর্ত মেনে নিয়েই উত্তীর্ণ হয়েছে রসাশ্রিত শিল্পে। আবেগের যথেচ্ছ প্রকাশ ও অসংযমী বিস্তার, যৌন প্রসঙ্গসমূহের স্বেচ্ছাচারী চিত্রায়ণের পথ পরিহার করে যথাসম্ভব ইঙ্গিত, আভাস ও প্রতীকের আশ্রয়ে মানব-মানবীর অন্তর্জাগতিক স্বরূপ গ্রন্থনায় তিনি সচেতন, আন্তরিক এবং আত্মনিবিষ্ট কথাশিল্পী’। (শহীদুল জহিরের ছোটগল্পে নর-নারীর প্রেমভাবনা, তাশরিক-ই-হাবিব।)

কিন্তু গল্পকার শহীদুল জহির তার লেখায় কি বা কারা এনেছেন এরকম আলাপের সঙ্গে সঙ্গে তার বাস্তব জীবনের ঘুপচি গলির গল্পও অনেকটাই আকর্ষণীয়। কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান তাঁর সঙ্গে তাঁরই বাসায় সাক্ষাতের ঘটনা বলতে গিয়ে টেনেছেন ফিওদর দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ বইয়ের রাসকলনিকভ। যাকে ঘরে বসে থাকতে দেখে বাড়িওয়ালি তাকে বলেই ফেলে যে সে কেন শুধু শুধু ঘরে বসে থাকে, কেনই বা সে কোন কাজ করে না। অবলীলায় রাসকলনিকভ উত্তর দেয়, ‘আমি সারা দিন চিন্তা করি, ওটাই আমার কাজ’। এমন এক রাসকলনিকভের ঘর দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে বসবাস করা ব্যক্তিটির নাম ছিলো শহীদুল জহির

চলে যাবার এতদিন পরেও যখন শহীদুল জহিরের বই খুলি, তখন মনে হয় শুধুমাত্র জাদুবাস্তবতার চর্চা কিংবা জীবনের গভীরতম টানাপোড়েনের জন্যই নয়, ঘুপচি গলির মত সাহিত্যিকদের চোখে বাহ্যিক তুচ্ছ বিষয়ের স্থানে তিনি যেভাবে একের পর এক গল্প ফেঁদেছেন, এবং সেই মহল্লার প্রত্যেকটি আলাদা চরিত্রের চোখ দিয়ে বিশেষ করে মুখের ভাষা দিয়ে সেই সময়কে ধরেছেন তা হয়তো শহীদুল জহিরকে অনন্য এক গল্পকারই শুধু বানাতে পেরেছে। নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে যেতে ঘুপচি গলির গল্পেও তিনি আর থেমে থাকেননি।

তবে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের একটি লেখায় শহীদুল জহিরকে কেন যেন একটু বেশি জীবন্ত মনে হয়। শাহাদুজ্জামান লিখছেন, ‘বেঁচে থাকলে হয়তো শহীদুল জহির ইতিমধ্যে লিখে ফেলতেন, ‘ভূতের গলিতে করোনা নেমে আসে। আমরা মহল্লার লোকেরা করোনা নিয়ে কথা বলি। আমার বলি ‘করোনা হালায় যায় না ক্যালা?’ কিংবা হয়তো তিনি তা লিখতেন না। তিনি বরং দক্ষিণ মৈশুন্দির বানর নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন’।

তাই শহীদুল জহিরের নিভৃতে জীবন কাটিয়ে দেয়া, আমার কাছে একটি সাধারণ হেয়ালি মনে হয় না। বরং শুধু মনে হয়, এক অহংবোধের উত্থান, যেই অহংকার মানবীয় শরীরে প্রকাশ পায় না, যেই অহংবোধ লুকিয়ে থাকে কিংবা প্রকাশ পায় শুধুই নিজের গল্পে।

তীরন্দাজ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক অনলাইন পত্রিকা

Edtior's Picks

Latest Articles

Copyright 2022 – Teerandaz

http://www.pixelsdigital.netDeveloped by Pixels Digital