‘গোয়েন্দা গল্প আমার একদম সহ্য হয় না।’—এমন একটা বাক্য দিয়ে আমিই মাসুদ রানা বইয়ের শুরু। অথচ সেই লোকই কিনা বাংলা রহস্য–সাহিত্যের ধারা বদলে দিলেন!
আবদুল গাফফার
কাজী আনোয়ার হোসেন শুধু লেখক ও অনুবাদকই নন। একজন প্রকাশক এবং ব্যবসায়ীও; যিনি বইকে পণ্যের মতো করেই পৌঁছে দিয়েছেন তৃণমূল পাঠকের কাছে। তৈরি করেছেন বইয়ের বাজার, অজস্র পাঠক আর কয়েক শ লেখক। সেটা যেমন সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমে, তেমনি রহস্যপত্রিকায় নতুন নতুন লেখক হাজির করে। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন সারাটা জীবন। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, মিডিয়া—মোটকথা প্রচারের আলো থেকে নিজেকে সযত্ন দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তারপরও প্রথম আলোর জন্য বেশ কয়েকবার কলম ধরেছেন। কখনো লিখেছেন গল্প-উপন্যাস, কখনো নিজের একান্ত কথা। দিয়েছেন সাক্ষাৎকারও। সেসব লেখায় বারবারই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তিনিই মাসুদ রানা। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো মাসুদ রানাকে দিয়েই নিবৃত্ত করেছেন তিনি। প্রথম আলোয় বিভিন্ন সময় প্রকাশিত সেসব লেখার সংকলন হলো আমিই মাসুদ রানা। সেবা প্রকাশনীর বাইরে কাজী আনোয়ার হোসেনের একমাত্র বই।
‘গোয়েন্দা গল্প আমার একদম সহ্য হয় না।’—এমন একটা বাক্য দিয়ে আমিই মাসুদ রানা বইয়ের শুরু। অথচ সেই লোকই কিনা বাংলা রহস্য–সাহিত্যের ধারা বদলে দিলেন! ব্যোমকেশ বক্সী, কিরীটী রায়, দস্যুবনহুর হয়ে একলাফে মাসুদ রানা। বাংলার রহস্য–সাহিত্যের পথচলাটা সহজ ছিল না। গোয়েন্দা কাহিনি লেখায় হাত দিয়েছিলেন নামীদামি সব লেখক। কিন্তু বিশ্বে গোয়েন্দা–সাহিত্যে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে, অথচ এ দেশ আটকে আছে তখন শার্লক হোমস কিংবা ব্যোমকেশের মতো কাহিনিতে। এমন একটা প্রেক্ষাপটে মাসুদ রানার মতো একটা স্পাই থ্রিলার লেখার কাজটা কঠিনই ছিল। সেই কঠিন কাজটা কীভাবে সম্ভব করলেন কাজী আনোয়ার হোসেন, তাঁর আমিই মাসুদ রানার শুরুতে স্পষ্ট করেছেন সে কথা, ‘আমার রহস্যজীবন’ নামে ছোট্ট এক স্মৃতিকথায়। তারপর বাবা কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে লিখেছেন পিতৃস্মৃতি। এরপরই এ বইয়ে মানুষের রহস্য অনুসন্ধান করেছেন কাজীদা, তিনটি ছোট গল্পে।
কাজী আনোয়ার হোসেন ধীর লয়ের গল্প সহ্য করতে পারতে না। আমিই মাসুদ রানাতেও সে ধারা বজায় রইল। গদ্যের পরই দুটি ছোট গল্প। ‘নিখুঁত ছক’ নামের গল্পের শুরুটা চিরচেনা উচ্চবিত্তের জীবন মনে হলেও শেষ গিয়ে ঠেকেছে ক্রাইম কাহিনিতে—পরকীয়া আর খুনে হলো যবনিকা।
আমিই মাসুদ রানার সবচেয়ে বড় সংযোজন চারটি মাসুদ রানার কাহিনি। সেবা প্রকাশনীর বাইরেও মাসুদ রানা প্রকাশিত হয়েছে। সেটা একমাত্র প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায়। ‘খুনে পিশাচ’ উপন্যাসটা আর দশটা রানা-কাহিনির চেয়ে একদম আলাদা। রানা ফিরেছে শিকড়ে। কক্সবাজার-টেকনাফের গহীন অরণ্যে মিশনে নেমেছে মাসুদ রানা। বিপদ ওত পেতে আছে পরতে পরতে। কিন্তু এর মধ্যে অরণ্যজীবনের হাতছানি, পাহাড়ের বিশালতা, বুনো প্রাণীদের বিচরণ, সঙ্গে দুর্ধর্ষ আন্ডারওয়ার্ল্ড। চিরায়ত মাসুদ রানাকে ছাপিয়ে সাহিত্যের রসনাও খুঁজে পাবেন এ উপন্যাসে। আরেকটি উপন্যাস ‘রানা-সোহানা’ও ঠাঁই পেয়েছে এ সংকলনে। এক খ্যাপাটে ফলিত পদার্থবিদ, রহস্য আর রানার-সোহানার রসায়ন, টান টান উত্তেজনা আর রোমাঞ্চে ভরপুর এক উপন্যাস। ‘অপারেশন লুঙ্গি’ রানা সিরিজের অসমাপ্ত আরেকটি উপন্যাস গ্রন্থিত হয়েছে। সঙ্গে ‘মিজান দাদা’—রানা সিরিজের বাইরের উপন্যাস।
সব শেষে পাঁচটি ছোট-বড় সাক্ষাৎকার গ্রন্থিত হয়েছে এখানে। সারা জীবন প্রচারের আলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা কাজী আনোয়ার হোসেন এসব সাক্ষাৎকারে ছিলেন অনেকটাই খোলামেলা—সেবা প্রকাশনী, মাসুদ রানা ও রহস্যপত্রিকা সম্পর্কে অনেক অজানা গল্পের ঝাঁপি মেলে ধরেছেন।
কাজীদা জানাচ্ছেন, ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের তৃতীয় বই স্বর্ণমৃগ যখন বাজারে এল, আগের দুটির মতোই পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়ল বটে, কিন্তু এবার এল অশ্লীলতার অভিযোগ। একটা পত্রিকা তাঁকে নিয়ে কটাক্ষ করে শেষে রায় দিল, লেখককে পল্টন ময়দানে বেঁধে পেটানো উচিত। কাজী আনোয়ার হোসেন মানহানির মামলা করলেন পত্রিকাটির বিরুদ্ধে। কিন্তু রায় তাঁর বিরুদ্ধে গেল। একপর্যায়ে নিষিদ্ধ করা হলো বইটিকে।
বিদেশি কাহিনির অ্যাডাপটেশন আর ঘোস্ট রাইটার নিয়ে অকপট কাজীদা। সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পাঠকের তুমুল চাওয়া পূরণ করতে হলে ছ-মাসান্তরে একট বই লিখলে চলবে না। প্রতি মাসেই তাদের নতুন নতুন রানা–কাহিনি চাই। সেই চাওয়া পূরণ করতেই হাত বাড়ালেন বিদেশি কাহিনির দিকে। বিদেশি কাহিনিকে নিজের মতো কেটে, ছেঁটে, দেশীয় রূপ-রস-গন্ধে নতুনভাবে হাজির করলেন। বইয়ের শুরুতেই লিখে দিলেন সে কথা। তাতেও ভাটা পড়ল না পাঠকের চাহিদায়, বরং বাড়ল। তখন পাঠকের চাহিদা পূরণ করতেই একাধিক গোস্ট রাইটার নিয়োগ দিলেন তিনি। এসব নানা গল্পকথায়, গল্প–উপন্যাস মিলিয়ে আমিই মাসুদ রানা যেন হয়ে উঠেছে কাজী আনোয়ার হোসেনের এক পূর্ণাঙ্গ অবয়ব।